‘মতাদর্শ আলাদা হলেও বুদ্ধবাবু ব্যক্তিগত কুৎসা করতেন না।’, জানালেন অধীর চৌধুরী

Share

নিজস্ব সংবাদদাতাঃ প্রবীণ বাম নেতার প্রয়াণে আবেগে ভাসলেন অধীর চৌধুরী। আজ অধীর চৌধুরীর লেখনীতে তাঁর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রতি শ্রদ্ধা উঠে এলো। সময়টা ১৯৯৬ সাল। নবগ্রাম থেকে জিতে প্রথম বার বিধানসভায় যাওয়া। তখন অনেক ছোটো। সেখানেই প্রথম বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সাথে আলাপ। তখন রমরমিয়ে চলছে বাম জমানা। রাজ্যে আমরা, কংগ্রেসরাই প্রধান প্রতিপক্ষ। ফলে বুদ্ধবাবুর সাথে তুমুল রাজনৈতিক বিরোধ ছিল। কিন্তু ওই বিরোধীতার জায়গা থেকে কখনো ব্যক্তিগত মনোমালিন্য হয়নি।

কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে দেখা হয়েছে। কথাও হয়েছে। কিন্তু কোনোবারই সৌজন্যের বিন্দুমাত্র খামতি দেখিনি। কোনো ঔদ্ধত্যও চোখে পড়েনি। ১৯৯৯ সালের লোকসভা ভোটে বহরমপুর থেকে দাঁড়ালাম। বাম জমানাতেও মুর্শিদাবাদ জেলা কিন্তু কংগ্রেসের ‘গড়’ হিসেবেই পরিচিত ছিল। সেই ভোটে জিতলাম। পৌঁছলাম সংসদে। অনেক চেষ্টা করেও বহরমপুর সে বার নিজেদের দখলে না নিতে পেরে একের পর এক কংগ্রেস কর্মীকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়েছিল তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার। বুদ্ধবাবু তখন রাজ্যের উপমুখ্যমন্ত্রী।


২০০০-এর নভেম্বরে তিনিই মুখ্যমন্ত্রিত্বের দায়িত্ব পেলেন। সাথে পুলিশমন্ত্রীরও। আমাদের মধ্যে তখন কার্যত সাপে-নেউলে সম্পর্ক। বামেদের ওই চাপের মুখেও কিন্তু কংগ্রেস কর্মীরা আমার জেলায় দলত্যাগ করে সিপিএমে যোগ দেননি। তখন কিন্তু এখনকার মতো রাজনৈতিক পরিবেশ ছিল না। ওই পরিস্থিতিতে দলীয় মতাদর্শ আলাদা হলেও বুদ্ধবাবুকে কখনও ব্যক্তিগত কুৎসা করতে শুনিনি। রাজনীতির স্বার্থে আমাদের অনেক কথা বলতে হয়। উনিও বলেছেন। আমিও বলেছি। কিন্তু আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কে কখনও তার প্রভাব পড়েনি।


বুদ্ধবাবুর আমলেই কংগ্রেসের ‘গড়’ ভাঙার চেষ্টা করে সিপিএম। বহরমপুরে জোড়া খুন-সহ একাধিক মামলায় আমাকে ফাঁসানো হয়। দিল্লি থেকে গ্রেফতার করা হয় আমাকে। সত্যি কথা বলতে কী, তখন কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয়েছিল বুদ্ধবাবুর সঙ্গে। ওঁর উপর খুব রাগও হয়েছিল। কিন্তু সেটা ধরে কেউই বসে থাকিনি। প্রতিহিংসাপরায়ণও হয়ে উঠিনি। ওই ঘটনা নিয়ে আমাদের দু’জনের মধ্যে কখনও কোনও কথাও হয়নি। মনোমালিন্যও হয়নি। বুদ্ধবাবু মানুষটাই আসলে অন্য রকম ছিলেন। ২০১১ সালে রাজ্যে বাম জমানার অবসান হয়ে গেল।


রাজপাটের শেষের দিকেও ওঁকে চাপের কাছে কোনও রকমের নতিস্বীকার করতে দেখিনি। সে বার বামেদের সরিয়ে মহাকরণের দখল নিল তৃণমূল। পরের ভোট, অর্থাৎ ২০১৬-র বিধানসভার আগে কংগ্রেসের সঙ্গে বামেদের জোট হল। সেই ভোটের প্রচারে এসেছিলেন রাহুল গান্ধী। পার্ক সার্কাস ময়দানে সভা। মঞ্চে বুদ্ধবাবু ছিলেন। তখনও ওঁর শরীরটা এত ভাঙেনি। তবে অসুস্থ ছিলেন। দলের স্বার্থেই সভায় এসেছিলেন। আমিও ছিলাম। ওই সভায় আমি সে দিন বলেছিলাম, ‘‘ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী থাকল বাংলা।’’

আর বুদ্ধবাবু বলেছিলেন, ‘‘এই সমাবেশে লাল ঝান্ডা উড়ছে। কংগ্রেস ও বামফ্রন্টের নেতারা এক মঞ্চে এসে দাঁড়িয়েছি। আমি ও রাহুল গান্ধী এক মঞ্চে। কেন? আমরা বুঝতে পারছি, এ বাংলার এখন ভয়ঙ্কর বিপদ।’’ ঐতিহাসিক তো বটেই। দিনটার কথা এখনও মনে আছে। বুদ্ধবাবু আদ্যোপান্ত দলের মানুষ ছিলেন। সারা জীবন দলের জন্য কাজ করে গেলেন। এখন রাজনীতিকদের মধ্যে আদর্শ খুব কম দেখা যায়। স্বার্থ চরিতার্থ করতে দলবদল এখন খুব সহজ কাজ। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে শেষ দিন পর্যন্ত নিজের নীতি, আদর্শ থেকে বিচ্যুত না হওয়া এমন একটা মানুষ বর্তমান রাজনীতিকদের কাছে আদর্শ হতে পারেন।

Share this article

Facebook
Twitter X
WhatsApp
Telegram
 
July 2025
M T W T F S S
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
28293031